হুনায়ুন আহমেদের উপন্যাসের রহস্যবিদ মিসির আলীর মত অনেক স্নায়বিক বা মানসিক এক্সপেরিমেন্ট আমি মাঝে মধ্যেই করে থাকি। বাস্তব প্রায়োগিক জীবনে যার অভিজ্ঞতা সব সময় সুখকর নয়। অনেক নিন্দুকে বলে আমি নাকি ইচ্ছে করেই স্কুল সার্টিফিকেট এর ফাইনাল পরীক্ষায় ভুগোল সাব্জেক্টের দিন দেরী করেছি। বিষয়টা মোটেও তা নয়। ওটা আসলেই অনিচ্ছাকৃত এক্সিডেন্টলি দেরী ছিল। ঐ দিন বিরাট হুলুস্থূল বেঁধে গিয়েছিল। একেবারে মন্ত্রণালয়ে হৈ চৈ, আমি নাকি ফার্স্ট স্ট্যান্ড করতে যাচ্ছি, বোর্ড কন্ট্রলার থেকে গাড়ী পাঠিয়ে দেওয়া হল, পরীক্ষা হলের চতুর্দিকে প্রহরা আর্মির বিশেষ সাপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেচারা আমি একেবারে ভড়কে গিয়ে হাতের লেখা খুব খারাপ হয়েছিল। এটা ছিল সেন্ট্রাল গভঃ মতিঝিল স্কুলের কথা। তামাম ইন্দো পাক ভারত মিলিয়ে এরকম স্কুল নাকি আর নেই । প্রাইম মিনিস্টার সোহরোওয়ার্দী নিজে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন '৫৭ সালে ,একটা ঢাকায় । আরেকটা পাকিস্তানের কোথায় যেন । কিন্তু সেই '৬২ সালে একটা ফার্স্ট স্ট্যান্ড হয়েছিল বটে ,তারপর দূর্বল ক্রিকেটের স্লগ ওভারের মত শুধুই হা পিত্যেশ ।
অবশ্য ক্লাস ফাইভে নরসিংদী ঘোড়াশাল ইউরিয়া ফার্টিলাইজার স্কুলে ডাক বিভাগ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে বেশ আলোচিত হয়েছিলাম। আমার জন্ম এখানে আর আমি ক্লাস সেভেন পড়া পর্যন্ত আব্বা এখানে কেমিস্ট ছিলেন। মেইলিং নিয়ে আমার প্ল্যান টা ছিল একটা খোলা প্যাকেটে আমাদের বাসার ঠিকানায় চিঠি ফেলব পোস্ট বক্সে, এই প্যাকেট ফিরে পেয়ে আবার নিজের কাছে চিঠি পাঠাব। এভাবে চলতেই থাকবে, আর কোন দিন পোস্ট অফিসের সিল যুক্ত খাম নতুন করে কিনতে হবে না। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এই আবিষ্কারের মুল ঝোঁকটা ছিল ফ্রী সিস্টেমের দিকে। যেমনঃ ইলেক্ট্রিসিটি ফ্রী, টেলিফোন ফ্রী, বর্তমান ইন্টার্নেট ফ্রী, ফ্রী ফুয়েল ইত্যাদি।
সে যাই হোক এই মেইলিং এক্সপেরিমেন্ট এর রেজাল্ট হয়ে গেল বেশ জালালী।
চিঠিটার খাম বার বার ব্যবহার এর জন্য যেহেতু আঠা লাগানো হয়নি সেহেতু পিওন মশাই আমার ম্যসেজটা খুলে পড়ে ফেলেছেন।
হায়, হায়, কি লেখা এসব, আমি নাকি কোথায়, আমাকে দশ হাজার টাকা পাঠাও। ঐ সময় এর আরো কত্ত কত্ত পরে পাঠাও, ওঠাও ,এখুনি,তখুনি,বেছে নাও চোখ বন্ধ --
এ জাতীয় অনলাইন কম্পানী গুলো এসেছে । অনলাইনে টিপ দিলেই সব চলে আসবে এরকম নির্বিকার ছিল না মানুষজন ।
পিওন ব্যটা খুব ভয় পেয়ে চিঠিটা চালান একদম আব্বাদের
এমোনিয়া প্ল্যান্টে সব অফিসারদের কাছে। আর ঠিক সেই দিনই ফ্যাক্টরীতে কি গন্ডগোল নাকি হয়েছিল। আব্বার বিরুদ্ধে কিছু নবীন
শিক্ষানবীশ স্টাফ জোট পাকিয়ে ছিল। আব্বা খুব অনেস্ট জেন্টলম্যান কেমিস্ট ছিলেন।
পুরো বি সি আই সি তে সবাই আব্বাকে সমঝ করত।
একবার আশুগঞ্জের ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরীর কি প্রবলেম সলভ করার জন্য আব্বার জন্য নাকি একেবারে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল,
পরে অবশ্য জাপানী মিটশুবিশি পাজেরো দিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা ঈদে বাড়িতে যেতে মাঝে মধ্যে সাধারণ জীপ গাড়ির পরিবর্তে এই
পাজেরো দিয়ে যেতাম। আমাদের গ্রামের বাড়ি ফ্যাক্টরী থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে ।
তো চিঠি পেয়ে আব্বার সাথে জাপানে ট্যুরে
গিয়েছিলেন এরকম একজন কলিগ হন্তদন্ত হয়ে আমাদের বাসায় ছুটে এলেন।
।"সোহাগ কই,সোহাগ কই"।
এম্নিতেই আমি হচ্ছি ভাল ছাত্র,তার ওপর বাসার ঠিক পাশেই মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিন সাব
( আমরা পিচ্চি মহলে তাকে ক্যাট ক্যাটে হুজুর বলতাম) পাঁচ বার আযান দেয় আর আমি পারতপক্ষে তিন বারই নামাজ পড়তে যেতাম।
সবাই আমাকে খুব রেসপেক্ট করত। আর স্টুডেন্টদের উপর খুব ইম্প্যাক্ট ছিল যে, আমি অযথা কোন মেয়ের দিকে তাকাতাম না।
একেবারে আগের যামানায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে হলে যেরকম জ্যান্টলম্যান হতে হয়। এখন তো দুষ্ট ক্যাটাগরীর লোক ও
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয় আর ফ্লোরিডাতে সিস্টেমের প্যাঁচে কি যেন কি করা হয়।
ঐদিন মনে হয় স্কুল বন্ধের
দিন ছিল আর আমি বাসাতেই ছিলাম। হন্ত দন্ত হয়ে আসা চাচা মশাই আমাকে দেখে বহুৎ আশ্বস্ত হলেন। আর চিঠিটা আবার
এমোনিয়া প্লান্টে ফেরত নিয়ে কি করলেন কে জানে, বিরাট ধুন্ধুমার হয়ে গেল। অনেকে সাসপেন্ড হয়ে গেল আর আব্বার উপর
বিশেষ কার্যাদেশ জারী করা হল যে, ওনি আর শিফটিং ডিউটি করতে পারবেন না, ওনি এখন থেকে জেনারেল শিফটে দ্বায়িত্ব পালন
করবেন। এই বছরই আমি প্রথম ফার্স্ট হই, ট্যেলেন্টপুলে বৃত্তি পাই। এর আগে শুধু সেকেন্ড বা থার্ড হতাম।কিন্তু এর পর থেকে
আমার একাডেমিক দক্ষতা এরকম হতে লাগল যে স্কুলের ইতিহাসে রেকর্ড মার্কস পেয়ে বিশাল ব্যবধানে ফার্স্ট হতে লাগলাম।
কিন্তু সেই মেইলিং এক্সপেরিমেন্টের অতৃপ্তিটা রয়েই গেল, ভ্যবাচেকা অবস্থার কারণে এটা নিয়ে আর বেশি এগুলাম না।
তাছাড়া সিস্টেম সম্পর্কে আমার নিজের তথ্যের অপর্যাপ্ততায় আমি নিজেই একটু শরমিন্দা হলাম। ওহ ও, চিঠির খামে তাহলে একটা সিল মেরে দেওয়া হয় যে এই খাম ব্যবহৃত হয়ে গেছে। বোঝা গেল সিস্টেম নিয়ে কাজ করতে কিছু এডভান্স চিন্তাও করতে হয় হাতে তথ্য থাক বা না থাক। এ সময় রেডিও আবিষ্কারক বোস সাহেবের প্রশাসন বা সিস্টেম জনিত একাকীত্ব এর কারণে তাঁর এই কৃতিত্বকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি বলে খুব সহাণুভুতি লাগল । আমি ভাবলাম বড় হয়ে অবশ্যই বিষয়টা আমি দেখব। স্নায়বিক বা মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে হয়ত আরো কিছু ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে মেলবোর্ন এয়ারপোর্টে একদম ইচ্ছে করে রেড এক্সিটে ঢুকে পড়া সত্যি অভাবনীয়। রেড এক্সিটে ঢুকলে যে এত সময় নষ্ট হয় এটা অবশ্য আমি জানতাম না।
ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে বিমান এ উঠার পর থেকেই আমার মেজাজ খারাপ ছিল। ইকনমি ক্লাসের টিকিট কাটা হয়েছিল। এই ক্যাটাগরিতে সব যে একদম ঢাকা শহরের বাসের মত গাদাগাদি তা আমার একদম ধারণাই ছিল না। আব্বা সব সময় ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজে অথবা এমিরেটস এ ফার্স্ট ক্লাসে আসা যাওয়া করতেন। ফার্স্ট ক্লাসে আসা যাওয়া করতে করতে আব্বা ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ থেকে প্লাটিনাম একসেস কার্ড পেয়েছিলেন, মানে বিশ্বের বিভিন্ন সিটিতে শপিং মল বা রেস্টুরেন্টে বিশেষ সুবিধা। লক্কর ঝক্কর বিমান ঝাঁকি দিয়ে যখন আকাশে উড়া শুরু করল তখন ভাবলাম যত তাড়াতাড়ি এটা সিংগাপুরে গিয়ে ল্যান্ড করবে ততই কল্যাণ । পরে একটা কিছু চিন্তা করা যাবে।
এটা ছিল সিংগাপুর এয়ার লাইন্স।
বিরক্তির এক পর্যায়ে সামনের সিটের পেছনের দিকে ছোট মনিটর আবিষ্কার করলাম।
এটাতে প্লেনের গতিপথ ট্র্যাক দেখা যায়। আমি অত্যন্ত গুরত্বের সাথে এটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বিবিধ টিপাটিপি শুরু করে দিলাম।
কিছুক্ষণ পর এয়ার হোস্টেজ কে ডেকে বললাম এটার কি জানি হয়েছে,মনে হয় ব্যাটারী ডাউন হয়ে গেছে।
এয়ার হোস্টেজ বিষয়টাকে পাত্তা দিল না, উলটো বলে গেল এটা আগে থেকেই মনে হয় সমস্যা, এটা আর না ধরতে।
এ সময় আমি অবশ্যই আর ক্লাস ফাইভের বাচ্চা ছেলে না বা কলেজের স্টুডেন্ট না। আমি খুব ভাল একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার।
এমনকি বর্তমানের খুব সাকসেসফুল ভিডিও স্ট্রিমিং একটা প্রজেক্ট ( যা গুগল কিনে নিয়েছে) এর প্রি ম্যাচিওর একটা কনসেপট নিয়ে
আমার প্রোগ্রামিং টিচার আমার জন্য ফাইজার ফাইসন্স গ্রুপের আই টি চীফের সাথে একটা মিটিং এরেঞ্জ করেছিলেন। এ ও এল
তখন সবে মাত্র সি এন এন এর ট্রেড টার্নারের সাথে মার্জ হয়েছিল। আমাদের হাইটেক মিটিং টা অবশ্য আই টি চীফ মশাইয়ের হাই সেলারি তৃপ্তির মধ্যবিত্ত
মানসিকতার কারণে বাস্তব প্রজেক্টের দিকে এগোতে পারেনি । নতুবা আমার প্রোগ্রামিং ধ্যান ধারণার জন্য আমার প্রোগ্রামিং টিচার
আমাকে যে পরিমাণ ভক্তি করতেন তাতে একটা স্টার্ট আপ হলেও হয়ে যেতে পারত আর তিনি নিজেও আমেরিকান একটা প্রোজেক্টে কাজ করছিলেন ডেল ফি
ল্যাংগুয়েজে ভার্সিটি কর্তৃওপক্ষের তত্ত্বাবধানে ।
কিন্তু আমার নিজের পার্সোনাল পিসি তে আমার কেন জানি খুব বেশি
প্রোগ্রামিং করা হয়ে উঠত না। বেশির ভাগ আশেপাশের স্টুডেন্টদের পিসি তে অথবা ভার্সিটির ল্যাব রুম পিসিতে প্রোগ্রামিং খুব জমে উঠত।
প্রথমতঃ হয়ত মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট কাজ করত। সেই আমলের এত দাম দিয়ে পিসি কেনা। অনেকটা পুরনো আমলের গরীব
মিধ্যবিত্তদের মত ,খোকন সোনা,রেডিওতে হাত দিও না ব্যাথা পাবে। দ্বিতীয়ত, উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম টা খুললেই
আমার কেমন জানি অবসাধ পায়। তৃতীয়ত, পিসি র একটা কিছু নষ্ট হলে দিল খুব ধক ধক করে । আসলে পুরো বিষয়টি আমার
কাছে ইউজার ফ্রেন্ডলি না। এমন কি এখন ও মনে হয়, স্মার্ট ডিভাইস একজন এসিস্ট্যান্ট এর কাছে থাকা উচিত ।
স্টুডেন্টদের প্রতি আমার সরাসরি কাউন্সিলিং হল , কম দামের সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ দিয়ে কাজ শুরু করা উচিত।
সিংগাপুর এয়ারপোর্টে প্লেন থামবার পর তিন ঘন্টা বিরতি। এখানে বিশাল লাউঞ্জে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম।
আরো কিছু স্টুডেন্ট
এর সাথে দেখা হল। কেউ ডিপ্লোমা,কেউ বা ব্যাচেলর আর দু একজন মাস্টার্স পড়তে যাচ্ছে।
মেলবোর্নে আমি যাচ্ছি লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ে
কম্পিউটার প্রকৌশল পড়তে। আমাকে জানানো হয়েছিল আরেকজন সিনিয়র ফিমেল স্টুডেন্ট এই ভার্সিটিতে যাচ্ছে। সে মালয়েশিয়াতে
দুই বছর পড়াশোনা করেছে, সেখান থেকে ক্রেডিট ট্রাস্নফার করে যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকা এয়ারপোর্টে ওনার দেখা পেলাম না। এখানে সিংগাপুর
এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে এই দূর দেশে মাতৃজাতির এই ফিমেল স্টুডেন্টকে আবিষ্কার করতে পেরে আমি অত্যন্ত ভরসা পেলাম। ওনার নাম
মারি বা মেরি বা মারিয়া। ওনি মনে হয় খ্রীষ্টান। একে তো মাতৃজাতির, তার ওপর আকার আকৃতিতে প্রায় পাহাড়ের মত। মারিয়া আম্মার
প্রতি আমার ভরসা আরো বেড়ে গেল।
ছোটবেলা থেকে মাতৃজাতির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতায়ই আমার এই অবস্থা। আমি বেশির ভাগ
সময় মারিয়া আম্মুর পেছন পেছন থাকতে লাগলাম।
আর বাসা থেকে এত দূরে সিংগাপুরে কিভাবে চলে এলাম ভাবতেই খুব মুষড়ে গেলাম।
এর আগে চিটাগাং চুয়েটে ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে গিয়ে ও পড়া হয়নি সেই ঢাকার খিঁলগাও এর বাসা থেকে অনেক দূরে বলে।
মারিয়া আম্মু অল্প সময় না যেতেই বিরক্ত হয়ে গেলেন।
এখানে সিংগা পুর এয়ারপোর্টে নিশ্চয়ই তিনি বেবি সিটিং করতে আসেন নি। আমাকে এভয়েড করার জন্য তিনি দ্রুত এখানে সেখানে বিভিন্ন সপিং কোর্ণারে হারিয়ে যেতে
থাকলেন।
শেষ পর্যন্ত আমি একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে আবিষ্কার করলাম। এরা আমারই মত এক জায়গায় ঝিম ধরে বসে থাকার পলিসিতে আছে। আমিও এদের পাশে ঝিম ধরে বসে থাকলাম। পরে জানলাম এরা পরস্পরের কাজিন। এরা যাচ্ছে ট্যাফে ডিপ্লোমা পড়তে। বাসা থেকে এত দূরে আমি একা একা, মোটামুটি হোমসিক লাগছিল। পরবর্তী প্লেনের একোনমি ক্লাসের সিট গুলো কেমন বাজে হতে পারে এ বিষয়টা ভুলে গেলাম।
সিংগাপুর থেকে মেলবোর্ন মাত্র তিন ঘন্টার ফ্লাইট। এই বারের প্লেনটা অবশ্য বেশ ভাল, সিট গুলোও
ভাল প্রশস্ত।
যাত্রীরা বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়ান, হয়ত সিংগাপুরে শপিং এ এসেছে অথবা ওয়ার্মে কিছুদিন
ঘুরে গেছে। সবার মধ্যে একটা উইক এন্ড বা
ভেকেশন ভাব।
বিমান উড়তে শুরু করার সাথে সাথেই আমি সামনের সিটের পেছনে মনিটর খুঁজতে লাগলাম। হা,হুতোস্মি,এই এরোপ্লেনে
ফ্লাইট এর গতিপথ ট্র্যাকিং মনিটর নেই।
তবে হ্যাঁ,সিটের হাতলে একটা ফোন সেটের মত পাওয়া গেল। আমি খপ করে ওটাকে উলটে পালটে দেখতে
লাগলাম। কিন্তু এটা দিয়ে কোথায় কিসের ফোন দেওয়া হয় তা বুঝতে পারছিলাম না।
ফোন সেট হাতে নিয়ে উল্টাতে পাল্টাতে দেখে পাশের
সিটের ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে বলল, উ ক্যান ফোন।
উ ক্যান ফোন -- এটা কোন পর্যাপ্ত তথ্য হল না ফোন সেট ব্যবহারের ব্যপারে। আসলে
টেকনোলজীর বেশির ভাগ সিস্টেম এখনো পর্যন্ত মোটেই ইউজার ফ্রেন্ডলি না।
আমি এয়ার হোস্টেজ কে ডাক দিলাম। এই, এই তোমাদের
এই ফোন সেটের একদম ব্যটারী ডাউন হয়ে গেছে।
এই এয়ার হোস্টেজ টা মনে হয় নতুন চাকরীতে জয়েন করেছে। সে সেট টা একটু উলটে
পালটে দেখে বলল, না না আমাদের এগুলো ব্যটারী দিয়ে চলে না।
এই দ্যাখো, সিটের হাতলের সাথে ফোন সেটের কর্ড কানেক্টেড।
সে
বেশ লজিক দেখাল।
এবার আমার লজিকে ধরল এক কম্পিউটার যেমন আরেক কম্পিউটারের সাথে ইন্টার্নেটের মাধ্যমে কানেক্টেড হয়ে
কথা বলে বা ডাটা আদান প্রদান করে তেমনি এই ফোন সেট দিয়ে এক সিট আরেক সিটের সাথে কথা বলে কিংবা হয়ত সরাসরি ককপিটের
পাইলটের সাথেও কথা বলা যায় কিনা কে জানে।
আমি মারিয়া আম্মুর সিট নাম্বার টা বাটনে টিপে কল করার চেষ্টা করলাম। ফ্লাইটে ওঠার
আগে সিট নম্বরটা জেনে রেখেছিলাম। C2Q বা এরকম একটা নাম্বার। কিন্তু কল হচ্ছিল না। আমি আবার এয়ার হোস্টেজকে ডাকলাম।
' এই যে তোমাদের এই ফোন সেট টা একদম গেছে। একদম নষ্ট। '
এয়ার হোস্টেজটা ফোন সেট টা আবার একটু উলটে পালটে দেখল।
তারপর আরেকটা এয়ার হোস্টেজকে ডাকল। সেও এটা একটু উলটে পালটে দেখল। এসময় তৃতীয় আরেকজন এয়ার হোস্টেজ এসে এই
জটলায় জয়েন করল।
এরা তিনজন মিলে ফিস ফিস করে কি যেন শলাপরামর্শ করল। আর আমি এমন ভাব করতে লাগলাম যে আমার
সিনিয়র একজন গার্জিয়ান দুরের এক সিটে বসে থেকে নিশ্চয়ই
এতক্ষণে কোন খোঁজ খবর না পেয়ে টেনশন করছে।
এয়ারহোস্টেজ ত্রয়
শেষ
পর্যন্ত একটা খালি সিট দেখিয়ে সেটাতে গিয়ে বসতে অনুরোধ করল আর ওটার ফোন সেট ব্যবহার করতে বলল। আমি বিমল প্রীত হয়ে
পাশের ব্যটাকে গুড বাই জানিয়ে নতুন সিটে গিয়ে আসন গ্রহণ করলাম।
এটা পাশাপাশি এক সাথে দুটা সিটই খালি। আমি বেশ আয়েস করে বসলাম। জানালা দিয়ে বিকেলের আকাশ। আকাশ পেয়ে ফোন সেট টিপাটিপি বাদ দিলাম। হুম, কি বিশাল আকাশ। আর আমরা বিমানে করে আকাশেই উড়ছি বটে। এয়ার হোস্টেজ ত্রয় একটু পর পর আমাকে দেখে যেতে লাগল। আমি ফোন সেট নিয়ে সহি সালামতে আছি কিনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখনো মেলবোর্ন আসেনি। আর আমার ভেতর আব্বা আম্মা বোনেদের থেকে অনেক দূরে চলে আসার বিষয়টা বুকের মাঝখানে বড় হতে হতে একদম গলায় গিয়ে দলা পাকাতে লাগল। আর কান কেমন জানি ঝালাপালা করতে লাগল।
ঢাকা এয়ারপোর্টে বড় বোনের সাথে ছোট বোন ও আম্মা এসেছিলেন। আব্বা স্ট্রোক করার পর ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। আমি লাগেজ
নিয়ে একদম ভেতরে চলে আসার পর ওজন করে দেখা গেল আমার লাগেজ গুলো নির্ধারিত ওজন সীমার বেশি। সেই আমলে বংগ
বাজার আর এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট মিলিয়ে প্রায় সাইত্রিশ হাজার টাকার বিভিন্ন ক্লথিং কিনে ব্যাগ বোঝাই হয়ে গিয়েছিল।
সুতরাং কিছু কাপড়চোপড় ফেরত দেওয়ার জন্য আবার ছোট বোনকে বিশেষ ব্যবস্থায় ভেতরে নিয়ে এসে কিছু কাপড় ফেরত দিলাম।
আদম আলাইহিসালাম বা নুহ আলাইহিসালাম নবীর প্রত্যেক সন্তানদের জোড়া ছিল। আমার মনে হয় আমাদের বড় দুই বোন
এক জোড়ার আর বড় দুই বোনের পরে তৃতীয়জন ও সবার শেষে আমি আরেক জোড়ার । এক জোড়ার সাথে আরেক জোড়ার বিবিধ তফাৎ থাকে।
আমি যখন মতিঝিল সেন্ট্রাল
গভঃ স্কুলে ভর্তি হই তখন আমার এই বোন ভর্তি হতে হয়েছিল ধানমন্ডি কামরুন্নেসা স্কুলে।
আব্বা লিবিয়া থেকে ছুটিতে এসে
আম্মাকে নিয়ে মতিঝিল সেন্ট্রাল গভঃ গার্লস স্কুলে গেলেন। সেখানে আব্বা আম্মা কে হেডমিস্ট্রেস জানালেন এই এখনই স্কুল ট্রান্সফার
এর পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। আপনাদের মেয়েকে তাড়াতাড়ি ধানমন্ডি থেকে নিয়ে আসেন।
পরীক্ষায় টিকে গিয়ে আমার বোন তখন এই
স্কুলে ভর্তি হল। আর দুই দিকে দুই স্কুলে আসা যাওয়ার ঝামেলা রইল না।
আমার আর কিছুই ভাল লাগছিল না। শুধু জানালা দিয়ে নিচে
তাকিয়ে ছিলাম কখন গ্রাউন্ড দেখা যাবে।
বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। হঠাৎ রাশি রাশি স্বর্ণের মত আলো ঝলমল দেখা গেল। যেন স্বর্ণ আর স্বর্ণ।
অন্ধকারে শুধু মুঠি মুঠি ঝলমল স্বর্ণ। মেলবোর্ন শহরের আলো। এ অবস্থা চলল প্রায় মিনিট পনের।
তারপর গ্রাউন্ড দেখা গেল।
বিমান ল্যান্ড করল।
বিমান থেকে বেরোনোর পর মারিয়াকে দেখে মাতৃজাতি সুলভ বিশেষ ভরসা ভরসা আর লাগছিল না। বরং তাকে খুব সাধারণ স্ক্যায়ার্ড (ভীত) ইন্টার্নেশনাল স্টুডেন্ট মনে হচ্ছিল। এয়ারপোর্টের বাইরে নিশ্চয়ই ইউনুভার্সিটির গাড়ি বসে আছে। যারা যারা এই ভার্সিটির তাদেরকে নিয়ে যাবে। একদম ফর্মাল ডেট অনুযায়ী আমি মেলবোর্নে এসেছি। দশ তারিখে ভার্সিটিতে সেমিস্টার ওরিয়েন্টেশন ডে। তার দুই দিন আগে। জুলাই মাস। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।
কিন্তু মারিয়া আম্মুকে এভয়েড করার জন্য
আমি ভাবলাম এরা সব চলে গেলে তারপর আমি বেরোব।
ইউনিভার্সিটির গাড়ি খুব আমার জন্য ওয়েট করে তারপর চলে যাবে।
আমি একা একা ট্যাক্সি করে আয়েশ করে যাব। কিন্তু সারি বদ্ধ পেসেঞ্জারদের এক সাথে বেরিয়ে যাওয়ার পথে আলাদা কোন
দাঁড়াবার বা থেমে থাকবার জায়গা নাই।
সুতরাং এক্সিট ফর্মে প্রহিভিটেড (নিয়ম বহির্ভুত) ফুড অংশে টিক দিয়ে রেড এক্সিটে
ঢুকতে গেলাম। সিকিউরিটি ভাবল আমি বোধ হয় ভুল করে এ পথে যাচ্ছি। সে আমার এক্সিট ফর্ম দেখল। ওহ, হো প্রোহিবিটেড
ফুড আছে নাকি আমার সাথে। আমার একটা ব্যাগে এক কেজি মুড়ি আছে। আমি বলব এটাকে অস্ট্রেলিয়াতে প্রোহিবিটেড
মনে করা হয় কিনা এই ধারণায় আমি টিক দিয়েছি।
রেড এক্সিটে ঢুকে আমি হতাশ হলাম। বেশ হেভী সিকিউরিটি অফিসিয়াল
ভাবের পরিবর্তে লম্বায় ছোটখাট একটা মেয়ে পুলিশ দ্বায়িত্ব পালন করছে।
তাও দেখে মনে হচ্ছে এই ডিপার্টমেন্টের চাকরিতে
বেশিদিন হয়নি। নাকি আমাকে দেখে সহজ সরল মনে করে এই মেয়ে পুলিশকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে আর হোমড়া চোমড়া টাইপের
পুলিশ গুলো দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
এর নাম ক্যাথি। সে আমাকে ফুড সংক্রান্ত কিছুই জিজ্ঞেস করল না। জিজ্ঞেস করল, হাউ
মেনি ব্যাগস।
আমি গোয়েন্দা টাইপ রোবটের মত বললাম, ফাইভ ব্যাগস। নাম্বার ওয়ান থার্টি কেজি, নাম্বার টু .. ।
আমার কথা
বলার ধরন দেখে ক্যাথি ভড়কে গেল।
কথায় বলে ব্যধিই সংক্রামক,স্বাস্থ্য নহে। ক্যাথির ভড়কে যাওয়া দেখে আমি আরো আর্নলড
সোয়েজগার এর মত এফ বি আই ভাব করতে লাগলাম। 'ট্রু লাইজ ' মুভিটা মনে হয় আমার বয়স যত তত বার দেখে মুখস্ত
করে ফেলেছিলাম।
ক্যাথি এবার পাসপোর্ট চাইল।
পাসপোর্ট টা নিয়ে কম্পিউটার এ কি যেন টিপাটিপি করল।
হুম। আবার পাসপোর্ট
ফেরত দিল।
ওপেন ইউর ব্যাগস।
আমি বাংলা তালার চাবি এগিয়ে দিলাম। ডু ইউর জব।
সত্যি প্রত্যেক লাগেজে আলাদা করে সাধারণ
তালাও সেঁটে দিয়েছিলাম।
ক্যাথি বলল, আমি জানি না কোন চাবিটা কোনটার জন্য।
আমি বললাম, আই হেল্প উ। ক্যান আই হেভ ওয়াটার টু ড্রিংক।
ক্যাথি
নিকটের একটা মেশিন থেকে ওয়ান টাইম গ্লাসে করে পানি দিল। একদম ঠান্ডা পানি। সব টুকু খেয়ে শুরু করলান ব্যাগ খোলা অভিযান।
এই ব্যাগ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় যেই ব্যাগ এটা নিউমার্কেট থেকে কেনা, প্রেসিডেন্ট ব্রান্ড। শুধু এই ব্যাগটা খুললেই আমার ধারণা
ক্যাথি মশাই, আমি ঢাকা কলেজের বিশেষ স্বাস্থ্যবান ছেলে আর আরো একজন সিকিউরিটি মিলেও এটা পুনরায় চেইন বন্ধ, তালা বন্ধ
করতে প্রায় আধা ঘন্টা লেগে যাবে। সেই টেনশনে আমি আগেই এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম।
অকে, লেটস ওপেন দ্যা ব্যাগ।
ব্যাগ
ওপেন হতেই মিশরের যাদুঘরের মত অজস্র কাপড়, হাবিজাবি উথলে বেরিয়ে গেল।
এক কোণে আবার একটা ব্যবহৃত লুংগিও উঁকি
দিতে লাগল। ফাঁকে ক্যালকুলাসের বই, সার্কিটের বই ও আছে।
সব উলটে পালটে দেখতে দেখতে বই গুলো দেখে সে যখন বলল,
ভেরি ইন্টারেস্টিং। তখন বুঝতে পারলাম ব্যপার তাহলে কিছু সিরিয়াসই বটে।
হাতাতে হাতাতে ক্যাথি যখন ব্যাগের কোণে ব্যবহৃত
লুংগীর দিকে গেল তখন ওয়াক করে উঠল।
হোয়াট দ্যা হেল ইজ দিস।
ক্লোজ দ্যা ব্যাগ, ওপেন এন আদার।
আমি বললাম আমি একা
এটা ক্লোস করতে পারবনা।
আর গিভ মি এন আদার গ্লাস অফ ওয়াটার।
আবার পানি খেয়ে ওয়ান টাইম গ্লাস ইয়াক বলে বিনের দিকে
ফেলে ব্যাগ বন্ধ করার অভিযান শুরু করা হল। ক্যাথি মশাই এর হুশ হল কথা আসলেই ঠিক। ব্যগটা বন্ধ করা বিস্তর কঠিন মনে হচ্ছে।
সে এক কোণা ধরে চাপ দেয়,আমি আরেক কোণা ধরে চেইন বন্ধ করতে যাই, কিন্তু ব্যাগ আর কাবুতে আসছে না।
অশান্তিতে আমি কলহ
জুড়ে দিলাম, ডিড নট আই টেল উ দিস ইস এ ভেরী হেভী ব্যাগ
এই বেহাল দশা দেখে এবার হোমড়া টাইপের একটা সিকিউরিটি এগিয়ে
এসে ব্যাগ বন্ধ করতে হেল্প করল।
আহ্, বেঁচে থাক বাপু সিকিউরিটি মশাই।
আসমানে সৃষ্টির শুরুতে জীবরাইল আর মিকাইল আলাইহিস সালাম ফেরেশতা দ্বয়কে যখন বলা হল নফস কে দেখে এস তখন
একটা বাক্স খুলতেই নফস তেড়বেড় করে বেরিয়ে ভীষণ বড় হতে লাগল। সম্মানিত প্রধান ফেরেশতা দ্বয় দ্রুত বাক্স টা চাপ দিয়ে বন্ধ করতে চাইলেন।
অনেক চাপাচাপির পর নফস বাক্সটার ভেতর বন্ধ হল। আমার গবেষণায় এটা হল বৈশ্বিক শ্বাশত নার্ভাল সেন্সিটিভিটি সিস্টেম।
এই সেন্ট্রাল সার্ভার সেন্সিভিটি সিস্টেম এ যতটুকু সেন্সিভিটি এলটেড করে একটা অস্তিত্বের সাথে কানেকটেড বা জুড়ে দেওয়া হয়
ততটুকুই তার নফস।
পরের ব্যাগ গুলোও খোলা হল,বন্ধ করা হল। শেষমেষ আমি আরেক গ্লাস পানি চেয়ে খেয়ে নিলাম।
বড় ব্যাগটা বন্ধ
করার অশান্তিতে আমার আর্নল্ড সোয়েজগার বা এফ বি আই ডিটেকটিভ ভাব করার বিলাসিতা একদম পগারপার হয়ে গেল। মারিয়া আম্মুর পিছে পিছে
এক সাথে বেরোনই মনে হয় ভাল ছিল। বাংগালী জাতিটা কেন যে খালি অনৈক্য করে।
হোমড়া সিকিউরিটিটা আমার লাগেজ সব গুছিয়ে
দিয়ে ট্রলিতে উঠিয়ে বিদায় দিল। প্লীজ, এন্টার দ্যা সিটি মেলবোর্ন।
রেড এক্সিট থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টের সাধারণ লাউঞ্জে এলাম। একটা মানি এক্সচেঞ্জ থেকে পকেটের নগদ কিছু ডলার অস্ট্রেলিয়ান ডলারে ভাংগিয়ে নিলাম। এতে করে প্রায় সাড়ে সাতশ অস্ট্রেলিয়ান ডলার হল। ( হাস্যকর বিষয় হল, আমার প্যান্টের ভেতরের পকেটে প্রায় তিন হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলারের টি টি ছিল, আর আমি প্রায় এক মাস পকেটে টি টি নিয়ে চলতাম। এটা এক মাস পরে ভাংগিয়ে ব্যাংক একাউন্টে ঢুকিয়ে ছিলাম। ) এখন চাইলে চকোলেট বা হাবিজাবি একটা কিছু কিনে খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। আর এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যেতেও ইচ্ছা করছে না। রেড এক্সিট থেকে বেরোতে বেরোতে এক ঘন্টা সময় বেশি লেগে গেছে। এখন বাজে প্রায় সাড়ে আটটা। সিংগাপুর থেকে আসা এই ফ্লাইটের কেউই এখন নেই।
এক পাশে একটা গোল বড় সোফাতে একটা বাচ্চা শুয়ে আছে আর তার উলটা পাশের
সোফাতে একটা অস্ট্রেলিয়ান বসে আছে। দেখলেই বোঝা যায় সাধারণ নেটিভ অস্ট্রেলিয়ান। ক্রিকেটার এলান বোর্ডারের মত
গোঁফ ওয়ালা।
আমার লাগেজের ভারী ট্রলি ঠেলে আমি তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কি ব্যপার তোমরা এখানে বসে আছ কেন?
পুরো এয়ারপোর্ট ফাঁকা হয়ে গেছে। সবাই চলে গেছে।
পিচ্চির বাবা যা বলল তার মানে হল পিচ্চির মাম সিংগাপুর থেকে আসার
কথা এই ফ্লাইটে। তারা অপেক্ষা করছে।
আমি ভাবলাম এরা আমার মতই অলস টাইপ।
এই ফ্লাইটের সবাই চলে গেছে, একদম
কোথাও কেউ নেই। পরবর্তী ফ্লাইট কয় ঘন্টা পরে আসছে পিচ্চির মাকে নিয়ে সেটা অবশ্য আমি আর জিজ্ঞাসা করলাম না।
আমি
এদের কাছেই এক জায়গায় বসে নিজকে এলিয়ে দিলাম। আমার মধ্যে কেমন একটা হতাশাবোধ হতে লাগল। কি দরকার
এই স্বল্প সময়ের দুনিয়াতে এত ঝায় ঝামেলার। সবারই উচিত যার যার মায়ের কোলে থেকে জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়া।
এই পিচ্চির মাম মনে হয় না আজকে আর অস্ট্রেলিয়া আসবে, হয়ত সিংগাপুরে এয়ারপোর্টে ঢুকবার আগেই নতুন কোন
প্রোগ্রামে ইনভলভড হয়ে গেছে আরো কয়েক দিনের জন্য।
আমি অবশ্য আমার এই নেতিবাচক পুর্বাভাষ এদেরকে বললাম না।
এদের পাশে থেকেই হুঁ হাঁ জাতীয় আলাপ চালিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম এভাবে আর কিছুক্ষণ বসে থাকলে
অতিরিক্ত হতাশাবোধ এড়ানোর জন্য আমি ঘুমিয়ে যাব। কাজেই এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। একটা কিছু করতে হবে।
আমি পিচ্চির বাবাকে আমার ভার্সিটিতে কিভাবে যোগাযোগ করব জিজ্ঞেস করলে সে ফোন বুথ দেখিয়ে দিল।
কিছু ডলার
ভাংগিয়ে কয়েন করে নিলাম ফোন বুথে ঢালবার জন্য।
কিন্তু কেন জানি ভার্সিটিতে ফোন দিতে ইচ্ছে করছে না। সেখানে
প্রফেশনাল ইন্টার্নেশনাল স্টুডেন্টরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে পৌঁছে গিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমোবার আয়োজন করছে।
অন্য কোথাও যাওয়া যেতে পারে বা অন্য কোথাও আপাততঃ উঠা উচিত।
কিন্তু না জেনে কোন হোটেলে উঠলে দেখা যাবে
দুই দিনে পাঁচশ ডলার চলে যাবে।
আমি আমার একটা পুরনো ডাইরী বই বের করে পাতা উল্টাতে লাগলাম। এটাতে হায়ারো গ্লিফিকসের
মত অসংখ্য নাম্বার। সিডনীতে পরিচিত কয়েকটা নাম্বার আছে আম্মার জ্ঞাতিগোষ্ঠি টাইপ। কিন্তু মেলবোর্নে কেউ নেই।
খালি লা ট্রোব ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন ইন্টার্নেশনাল করেসপন্ডসের নাম্বার।
হঠাৎ খেয়াল হল, ঢাকাতে মহাখালি ডি ও এইচ এস এ এক
অফিসে মেলবোর্নের এক ফিস এক্সপোর্টার হারুন সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিল। হারুন সাহেবের আবার দাঁড়িও ছিল।
কিন্তু হারুন সাহেবের কোন নাম্বার ডাইরীতে পাওয়া গেল না। তারপর মনে হল একটা পাইপ কোম্পানী, সে তার পার্টনারের
শেয়ার কিছু শোধবোধ করে কিনে নিয়েছে,সেই পার্টনার মরে গেছে৷ তার ছেলে মেয়ে মেলবোর্ন থাকে। মেয়েটার বিয়ের কার্ড
মতিঝিলের ঐ অফিসে ব্যটার টেবিলের এক কোণায় পড়েছিল। পাত্রের নাম ক্রিস। পোলিশ ছেলে। এই নাম্বারটা ডাইরীতে আছে।
আমি বিজয়ের ভংগীতে পিচ্চির দিকে তাকালাম। এই যে মশায় তোমার মাম আসিতে আসিতে আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি,
মানে বেরিয়ে যাবার ব্যপারে অন্তত উৎসাহবোধ করছি।
আমি ফোন বুথে কয়েন ঢেলে দিলাম ফোন। হা, হুতোস্মি, কি যেন মেশিন আন্সার
আসে ইংরেজীতে যে আমরা এখন বাড়িতে নেই একটু পড়ে আবার ফোন কর।
আমি আবার হতাশ হয়ে পিচ্চিদের আশেপাশে আসন
গ্রহণ করলাম। অলসতা আর বসে থাকার দিক দিয়ে এরা বেশি অগ্রগামী না আমি এটা চিন্তা করতে থাকলাম।
এখন ঘড়িতে বাজে রাত সাড়ে নয়টা।
আজকের রাতটা না হয় এখানেই বসে কাটিয়ে দিই। বসে বসে দীর্ঘ সময়
কাটানোতে আমার জুড়ি নেই। এমনকি কয়েক বছরও আমি কাটিয়ে দিতে পারি। রেড এক্সিটে ঢুকবার সময়
যেমনটা প্ল্যানিং ছিল যে ট্যাক্সী করে একা একা ভার্সিটি যাব সেটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি। কেননা এত লেটে
গিয়ে বোকা সাজবার কোন মানে হয় না।
ঢাকায় বাসাতে ফোন দেওয়া যেতে পারে যে আমি মেলবোর্ন পৌঁছেছি,
কিন্তু এতে করে অতি আবেগে এমন ও হতে পারে এখান থেকেই আবার ঢাকায় রওনা দিতে হতে পারে। কাজেই চুপ করে বসে থাকলাম।
এদিকে পিচ্চি দেখি উলটে পালটে নানান ভাবে শুয়ে কিছু ঘুমায় আবার জেগে তার বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা
বলে আবার উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে।
পিচ্চির শুয়ে থাকার আয়েস দেখে আমারও খুব শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল।
কিন্তু উঠে গিয়ে ফোন বুথে আবার একই নাম্বারে ফোন দিলাম সেই ক্রিস মশাইয়ের বিয়ের কার্ডে প্রাপ্ত নাম্বারে,
আবারো অটো আন্সার বাড়িতে কেউ নাই।
এভাবে তিন ঘন্টা পরে প্রায় এগারটার দিকে ফোন করে পাওয়া গেল ,
কে যেন ফোন রিসিভ করল।
আমি শুধু বললাম, আমি রায়হান, এয়ারপোর্টে বসে আছি।
বাহ এতটুকু বলতেই ওপাশে
তোড়জোড় লেগে গেল।
হ্যাঁ,রায়হান, তুমি কি অনেকক্ষণ বসে আছ? আমরা একটু বাইরে ছিলাম।
আরে বাপু,
আমাকে চিনে না জানে না কিন্তু কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন আমাকে একদম চেনে বা সব এপয়েন্টমেন্ট করা আগে
থেকে যে আমি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এদের বাসায় উঠব।
ফোন রিসিভ করেছিল ক্রিস মশাইয়ের যার সাথে বিয়ে
হয়েছে সেই আপুর ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়টা, এর নাম পিন্নি।
পিন্নি ভাই মোটামুটি কয়েক মিনিটের মধ্যে মেলবোর্ন
শহরে বাঙালি মহলে জানান দিয়ে দিলেন যে রায়হান এয়ারপোর্টে বসে আছে আর সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব।
যেখানে যত বাংগালী ট্যাক্সি ড্রাইভার আছে তাদের নিজস্ব যোগাযোগের মাধ্যমে কেউ একজন যেন আমাকে এসে
এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যায়।
কিন্তু আশেপাশে সাধারণ দুরত্বে কোন বাংগালী ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিল না। আর পিন্নী
ভাইদের বাসাটা হল এয়ারপোর্ট থেকে অনেক দূরে ড্যান্ডিনংএ, এন্ডেভার হিলস এ।
আমি পিন্নি ভাইকে শুধু ঠিকানাটা
জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম।
এবার আমি পুরোপুরি মাইন্ড সেট আপ করে নিলাম যে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি।
পিচ্চি আর পিচ্চির বাপের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, দাঁড়াও আমি ও ঝাঁড়া এক সপ্তাহ উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে
কাটাবো। মেলবোর্নের ওয়েদার খুব ভালই মনে হচ্ছে।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরোবার আগে আমি শীতের সর্বোচ্চ যত পোশাক
আছে গায়ে চাপিয়ে নিলাম। পুর্ব প্রস্তুতি হিসেবে আলাদা একটা ব্যাগে এগুলো ছিল। সাধারণ স্যূট কোট, তার ভেতরে
আরো কিছু গরম কাপড় আর সব গুলোর ওপরে ভারী লং ডিটেক্টিভ কোট। ভাবলাম এই মুহুর্তে আমাকে দেখলে ক্যাথি
মশাই আন্ড গং অবশ্যই একটু ভড়কে যেত।
এয়ারপোর্ট এর চোহদ্দি থেকে ভারী লাগেজের ট্রলি নিয়ে যে ই না বের
হয়েছি অমনি ভীষণ ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা একের পর এক এসে আমার হেভী লং ডিটেক্টিভ কোট উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার
উপক্রম হল। এটা ছিল একটু ঠান্ডা রাত ঐদিন, আট বা নয় ডিগ্রী সেলসিয়াস।
এদিকে সামনে কোথায় কোন দিকে কি কিছুই
বুঝতে পারছিলাম না। এভাবে ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় কয়েক মিনিট চলে গেল। বাতাসও একটু শান্ত হল। ধীরে ধীরে আমি
বুঝে বুঝে এগুতে থাকলাম।
এখান থেকে স্কাই নামক বিশেষ বাসে স্পেন্সার স্ট্রীটে গেলাম। ভাড়া নিল তের ডলার।
এখান
থেকে ট্যাক্সী। ট্যাক্সী ড্রাইভার একজন অস্ট্রেলিয়ান।
সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমি নতুন এসেছি কিনা।
আমি বললাম,
হ্যাঁ
সে বলল,ওয়েলকাম টু দ্যা সানি অস্ট্রেলিয়া।
ট্যাক্সি অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যখন ড্যানডিনং এন্ডেভার হিলস এ ক্রীস
মশায়ের শ্বাশুড়ীর বাসায় পৌঁছল ততক্ষণে ভাড়া ঊঠে গেছে ছাপান্ন ডলার।
ভাড়া নিয়ে পিন্নি ভাই মনক্ষুন্ন হলেন। আমি
যদি অন্তঃত স্পেন্সার স্ট্রীটে নেমে একটা ফোন দিতাম আর সেখান থেকে অবশ্যই বাংগালী
ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে নিয়ে
আসতে পারত আর শেষে পিন্নি ভাই ওনার আম্মার বয়স্ক ভাতা কার্ড পাঞ্চ করে দিলে নাকি অর্ধেক ভাড়া সেভ হয়ে যেত।
পিন্নি ভাই এর ছোট ভাই মিকি ভাই ট্যাক্সি থেকে লাগেজ নামাতে সাহায্য করলেন।